শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু
প্রশ্ন : আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে অসংখ্য নেয়ামত দিয়ে ধন্য করেছেন। আমাদের প্রতি তাঁর এই সকল নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের সর্বোত্তম উপায় কী?
প্রথমত :
ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানোর উদ্দেশ্য হলো কারও উপকার এবং সদয় আচরণের প্রতিদান স্বরূপ তার প্রশংসা করা এবং তার প্রতিও সদয় আচরণ করা। মানুষের ধন্যবাদ এবং প্রশংসা পাওয়ার সবচেয়ে যোগ্য সত্ত্বা হলেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয় তা‘আলা। কারণ জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রেই তিনি আমাদেরকে অসংখ্য অনুগ্রহের মাধ্যমে ধন্য করছেন। এইসব নেয়ামতের জন্য তিনি আমাদেরকে তার প্রশংসা করার এবং সেগুলোকে অস্বীকার না করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় করো, আমার সাথে কুফরী কোরো না।” [আল-বাকারা; ২ : ১৫২]
দ্বিতীয়ত :
যারা আল্লাহ্র এই নির্দেশের আনুগত্য করেছেন এবং তাঁর যোগ্য শোকরকারী বান্দা বলে বিবেচিত হওয়া পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা করেছেন গেছেন, তারা হলেন নবী এবং রাসূলগণ (‘আলাইহিমুস সালাম)।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“নিশ্চয়, ইবরাহীম ছিলেন (একাই) এক উম্মত (একটি জাতির জীবন্ত প্রতীক), আল্লাহ্র একান্ত অনুগত, ও একনিষ্ঠ। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার রবের নেয়ামতের শোকরকারী। তিনি তাকে বাছাই করেছেন এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছিলেন।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১২০-১২১]
“সে তাদের বংশধর, যাদেরকে আমি নূহের সাথে আরোহণ করিয়েছিলাম, নিশ্চয় তিনি ছিলেন কৃতজ্ঞ বান্দা।” [ সূরা বনী ইসরাইল; ১৭ : ৩]
তৃতীয়ত :
আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে আমাদের প্রতি তাঁর কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেসব জন্য আমাদেরকে শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, খুব অল্প কিছু মানুষই তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে থাকে।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
১। “হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযিক দিয়েছি তা থেকে আহার করো এবং আল্লাহ্র জন্য শোকর করো যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।” [সূরা বাকারা; ২ : ১৭২]
২। “আর অবশ্যই আমি তো তোমাদেরকে যমীনে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতে তোমাদের জন্য রেখেছি জীবনোপকরণ। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।” [সূরা আরাফ; ৭ : ১০]
৩। “আর তাঁর নির্দেশনসমূহের মধ্যে রয়েছে, তিনি [বৃষ্টির] সুসংবাদ বহনকারী হিসেবে বাতাস প্রেরণ করেন এবং যাতে তিনি তোমাদেরকে তাঁর রহমত আস্বাদন করাতে পারেন এবং যাতে তাঁর নির্দেশে নৌযানগুলো চলাচল করে, আর যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ থেকে কিছু সন্ধান করতে পারো। আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” [সূরা রুম; ৩০ : ৪৬]
৪। আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে যেসব আধ্যাত্মিক নেয়ামতের উল্লেখ করেছেন সেগুলো হলো (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“হে মু’মিনগণ! যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ এবং কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত করো, মাথা মাসেহ করো এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত করো)। আর যদি তোমরা অপবিত্র থাকো, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও। আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাকো অথবা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা যদি স্ত্রী সহবাস করো অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসেহ করো। আল্লাহ্ তোমাদের উপর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না। বরং তিনি তোমাদের পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের উপর তাঁর নেয়ামত পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।” [সূরা মায়েদা; ৫ : ৬]
রয়েছে আরও অনেক অফুরন্ত নেয়ামত। আমরা এখানে সেগুলো থেকে মাত্র কয়েকটা উল্লেখ করলাম। বলাই বাহুল্য যে, আল্লাহ্র সমস্ত নেয়ামতের তালিকা করা অসম্ভব। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“আর তোমরা যা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকে তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এবং যদি তোমরা আল্লাহ্র নেয়ামতের গণনা করো, তবে তার সংখ্যা নিরূপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অতিমাত্রায় যালিম, ও অকৃতজ্ঞ।” [সূরা ইবরাহীম; ১৪ : ৩৪]
আমরা আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে তিনি আমাদের ত্রুটিবিচ্যুতিকে ক্ষমা করে দেবেন এবং আমাদের প্রতি করুনা করবেন। এই মর্মে তিনি বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“আর যদি তোমরা আল্লাহ্র নেয়মত গণনা করো, তবে তার ইয়ত্তা পাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১৮]
আল্লাহ্ না চাইলে, কেউ তাঁর প্রশংসা করতে পারে না। তাই মুসলিমরা সর্বদাই আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চেয়ে প্রার্থনা করে, যেন তিনি তাদেরকে তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া করার সামর্থ্য দান করেন। একারণেই বিশুদ্ধ হাদীসে আল্লাহ্র প্রশংসা করার জন্য তাঁর সাহায্য চেয়ে দো‘আ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মু‘আয ইবনু জাবাল (রা) বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্র রাসুল (সা) তার হাত ধরে বললেন :
“হে মু‘আয! আল্লাহ্র কসম, তোমাকে আমি ভালবাসি, আল্লাহ্র কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” তারপর তিনি বললেন, “হে মু‘আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, প্রত্যেক সালাতের শেষে তুমি বলতে ভুলে যাবে না : হে আল্লাহ্! তোমাকে উত্তমরূপে স্মরণ করার, তোমার শুকরিয়া করার এবং তোমার ইবাদত করার জন্য আমাকে সাহায্য করো।” [আবু দাউদ (১৫২২) এবং নাসা‘ঈ কর্তৃক সংকলিত; সহীহ আবি দাউদে আল-আলবানি হাদীসটি সহীহ বলে মত দিয়েছেন]
আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে, আমরা তাঁর পক্ষ থেকে আরও বেশী নেয়ামত প্রাপ্ত হবো। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।’ ” [ইবরাহীম; ১৪ : ৭]
চতুর্থত :
মানুষ কীভাবে তার প্রতিপালকের দেওয়া নেয়ামতরাজির শুকরিয়া আদায় করবে? আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে সবগুলো নির্ধারিত শর্তসমূহ পূর্ণ করা অপরিহার্য। যেমন : অন্তরের শুকরিয়া, জিহ্বার শুকরিয়া এবং অন্য সকল শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া।
ইবনুল কাইয়্যিম (র) বলেন :
“অন্তরের শুকরিয়া হলো আত্মসমর্পণ এবং বিনম্রতায়; জিহ্বার শুকরিয়া হলো প্রশংসা এবং স্বীকারোক্তিতে; আর শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া হলো আনুগত্য এবং বশ্যতায়।” [মাদারিজ আল-সালিকীন (২/২৪৬)]
উল্লিখিত বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ :
১. অন্তরের শুকরিয়া : এর অর্থ হলো, আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন, অন্তর সেই অনুগ্রহসমূহকে পূর্ণ গুরুত্বের সাথে উপলব্ধি করে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে যে, কেবল আল্লাহ্ই তাকে এইসব অনুগ্রহ দান করেছেন যার কোনো শরীক বা অংশীদার নেই। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“আর তোমাদের কাছে যেসব নেয়ামত আছে তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে।” [আন-নাহল; ১৬ : ৫৩]
আমরা সমস্ত নেয়ামত যে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে পাই, তা স্বীকার করা কেবল মুস্তাহাব (উৎসাহিত) নয়; বরং তা ফরয (বাধ্যতামূলক)। এইসব নেয়ামত আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে এসেছে বলে বিশ্বাস করলে তা হবে কুফরী।
শায়েখ আব্দুর রাহ্মান আস-সা‘দি (র) বলেছেন :
“মানুষকে পরিপূর্ণভাবে স্বীকার করতে হবে যে, সমস্ত নেয়ামতরাজি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। তবেই সে পরিপূর্ণভাবে তাওহীদ-কে অর্জন করবে। যে কেউ মুখে বা অন্তরে আল্লাহ্র নেয়ামতসমূহকে অস্বীকার করবে, সে একজন কাফির এবং ইসলামের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
যে দৃঢ়ভাবে অন্তরে বিশ্বাস করে যে, সকল নেয়ামত শুধুমাত্র আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, আবার কখনও কখনও সেগুলোকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, কখনও নিজের কর্ম বা অন্যের প্রচেষ্টার ফসল মনে করে – যেমনটি অনেক মানুষের মুখে শোনা যায় – তাহলে তাকে তাওবা করতে হবে এবং সমস্ত নেয়ামতসমূহ তার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে বলে মনে করবে না এবং সে অবশ্যই নিজেকে দিয়ে তা (তাওবা) করাবে। কারণ আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে, ঈমান এবং তাওহীদ অর্জন করা যায় না।
ঈমানের মূলকথাই হলো আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করা যা তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত : বান্দার প্রতি আল্লাহ্র সমস্ত নেয়ামতকে অন্তরে স্বীকার করা এবং সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা; আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করা; এবং এই শুকরিয়াকে কাজে লাগিয়ে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত এবং আনুগত্য করা যিনি সমস্ত নেয়ামতের যোগানদাতা।” [আল-কাওল আস্-সাদীদ ফী মাকাসিদুত তাওহীদ (পৃষ্ঠা ১৪০)]
যারা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না, তারা কোন ধরণের মানুষ, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“তারা আল্লাহ্র নেয়ামত চেনে, তারপরও তা অস্বীকার করে, আর তাদের অধিকাংশই কাফির।” [সূরা নাহল; ১৬ : ৮৩]
ইবনু কাসির (র) বলেছেন : “তারা তো নিজেরাই জানে যে, একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলাই হচ্ছেন নিয়ামতরাজি দানকারী। কিন্তু এটা জানা সত্ত্বেও তারা এগুলো অস্বীকার করছে এবং তারা অন্যদের ইবাদত করছে। এমনকি তারা মনে করছে যে, সাহায্যকারী অমুক, আহার্যদাতা অমুক।” [তাফসীর ইবনু কাসির (৪/৫৯২)]
২. মুখের শুকরিয়া : এর অর্থ হলো, সমস্ত নেয়ামত রাজি শুধুমাত্র আল্লাহ্র পক্ষ থেকে – একথা অন্তরে বিশ্বাস করার পর, তা মৌখিকভাবে স্বীকার করা এবং নিজের জিহ্বাকে সর্বদায় আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র প্রশংসায় নিয়োজিত রাখা।
তাঁর বান্দা মুহাম্মাদের (সা) প্রতি তাঁর নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
“তিনি তোমাকে পেয়েছেন নিঃস্ব। অতঃপর তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।” [সূরা আদ-দুহা; ৯৩ : ৮]
আল্লাহ্র এই নেয়ামতের জন্য রাসূলকে কী করতে হবে, তা আল্লাহ্ তা‘আলা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন :
“আর তোমার রবের অনুগ্রহ তুমি বর্ণনা করো।” [সূরা আদ-দুহা; ৯৩ : ১১]
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যা ইবনু কাসির (র) বলেছেন : “যখন আপনি নিঃস্ব এবং অভাবগ্রস্থ ছিলেন, আল্লাহ্ তখন আপনাকে সমৃদ্ধ এবং অভাবমুক্ত করেছেন করেছেন : তাই আপনার প্রতি অনুগ্রহের কথা ঘোষণা করুন।” [তাফসীর ইবনু কাসির (৮/৪২৭)]
আনাস ইবনু মালিক থেকে বর্ণিত। আল্লাহ্র রাসূল (সা) বলেছেন : “আল্লাহ্ সেই ব্যক্তির প্রতি খুশি হন, যে কোনো খাবার খাওয়ার পরে তাঁর প্রশংসা করে অথবা যে কোনো পান করার পরে তাঁর প্রশংসা করে।” [সহীহ্ মুসলিম (২৭৩৪)]
আবুল ‘আব্বাস আল-কুরতুবি (র) বলেছেন :
উল্লিখিত হাসীসে প্রশংসা বলতে শুকরিয়া আদায় করাকে বোঝানো হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, প্রশংসার মাধ্যমে শুকরিয়া হতে পারে কিন্তু শুকরিয়ার মাধ্যমে প্রশংসা নাও হতে পারে। নেয়ামত সংখ্যায় যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার জন্য শুকরিয়া আদায় করাই হলো আল্লাহ্ তা‘আলা’র সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোত্তম উপায় যা জান্নাতের অধিবাসীদের সবচেয়ে মহান বৈশিষ্ট্য। যখন জান্নাতীরা বলবে, “আপনি আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা সৃষ্টির মধ্যে অন্য কাউকে দেননি,” তখন আল্লাহ্ তাদের উদ্দেশে বলবেন : “আমি কি তোমাদেরকে তার চেয়েও অধিক উত্তম কিছু দেবো না?” তারা বলবে “সেটা কী? আপনি কি আমাদের মুখমণ্ডলগুলোকে উজ্জ্বল করেননি এবং আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি রক্ষা করেননি? তিনি বলবেন, “তোমাদের প্রতি আমি সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম এবং এরপর আর কখনোও তোমাদের প্রতি রাগান্বিত হবো না।”
“এই বিরাট সম্মান অর্জনের উপায় হলো শুররিয়া আদায় করা। কারণ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে শুধুমাত্র আল্লাহ্কেই ওই নেয়ামতের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকার করা হয়। যিনি নেয়ামতসমূহকে সম্মান ও অনুগ্রহস্বরূপ তাঁর বান্দার নিকট পৌঁছে দেন। যে বান্দা নিঃস্ব এবং অসহায় এবং যে অনুগ্রহ ছাড়া চলতে পারে না। কাজেই শুকরিয়া আদায় করাটা আল্লাহ্র হক্ব এবং আমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি দেওয়া বান্দার অত্যাবশ্যক কর্তব্য। একারণেই আল্লাহ্ তাঁর শুকরিয়া আদায়ের পুরস্কারকে এত সম্মানজনক করেছেন।” [আল-মুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীস কিতাব মুসলিম (৭/৬০,৬১)]
এ কারনে সালাদের কেউ কেউ বলেছেন : কেউ কোনো নেয়ামতের কথা গোপন করলে সে ওই নেয়ামতকে অস্বীকার করল, আর কোনো নেয়ামতের কথা প্রকাশ করলে সে ওই ওটার জন্য শুকরিয়া আদায় করলো।
এ কথার মন্তব্যে ইবনুল কায়্যিম (র) বলেছেন :
“আল্লাহ্ যখন কোনো ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন, তিনি ওই বান্দার উপর সেই অনুগ্রহের প্রভাব দেখতে ভালোবাসেন।” [মাদারিজি আল সালেকিন (২/২৪৬)]
উমার ইবনু আব্দুল আযীয (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : (আল্লাহ্র) নেয়ামতের কথা পরস্পরকে স্মরণ করিয়ে দাও। কারণ সেগুলো আলোচনা করাও হলো শুকরিয়া আদায় করা।
৩. শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া : এর অর্থ হলো শারীরিক ক্ষমতাকে আল্লাহ্র আনুগত্যের জন্য ব্যবহার করা এবং সেগুলোকে সবধরণের পাপাচার এবং আল্লাহ্র বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যেসব কাজ আল্লাহ্ নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“হে দাউদ পরিবার, তোমরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ‘আমল করে যাও।” [সূরা সাবা; ৩৪ : ১৩]
‘আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত : “আল্লাহ্র রাসুল (সা) যখন সালাত আদায় করতেন, তিনি এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর পা দুটো ফুলে যেতো। ‘আয়েশা (রা) বললেন : হে আল্লাহ্র রাসুল! আপনি এমনটি করছেন যখন আল্লাহ্ আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? তিনি বললেন : “হে আয়েশা! আমি কি শোকর গুজারি বান্দা হবো না?” [আল-বুখারি (৪৫৫৭) এবং মুসলিম (২৮২০)]
ইবনু বাত্তল (রা) বলেছেন :
আত-তাবারি বলেছেন : এব্যাপারে বিশুদ্ধ মত হলো, শুকরিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, ওই নেয়ামত আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে নয় এবং কাজের (শুকরিয়ার) মধ্য দিয়েই তার প্রমাণ এবং যেহেতু শুকরিয়া আদায় করা হয়েছে তাই সেটা প্রমাণিত। তবে প্রমাণিত হওয়ার পর ব্যক্তির কাজকর্ম যদি ভিন্নরূপ দেখা যায়, তাহলে সে নিজেকে শোকরকারী বলার যোগ্য নয়। একে মৌখিক শুকরিয়া বলা যেতে পারে। একথা যে সত্য, তার প্রমাণ হলো আল্লাহ্ তা‘আলা’র বাণী (অর্থের ব্যাখ্যা) : “হে দাউদ পরিবার, তোমরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ‘আমল করে যাও।” [সূরা সাবা; ৩৪ : ১৩]। এটি জানা কথা যে, আল্লাহ্ যখন তাদের প্রতি তাঁর নেয়ামতের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে বলেছিলেন, তখন তিনি তাদেরকে শুধু মুখেই ওকথা স্বীকার করার জন্য আদেশ করেননি। কারণ তাদের প্রতি নেয়ামতসমূহ আল্লাহ্র দেওয়া একথা তারা অস্বীকার করেনি। বরং তিনি তাদেরকে আনুগত্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার হুকুম দিয়েছিলেন। ঠিক এ কারণেই, রাতে সালাত আদায় করার সময় যখন রাসূলের (সা) পা দুটো ফুলে যেতো, তখন তিনি বলতেন : আমি কি শোকর গুজারি বান্দা হবো না? [শাহ্র সহীহ্ আল-বুখারি (১০/১৮৩,১৮৪)]
আবু হারুন বলেন : হঠাৎ আবু হাজিমের সাথে আমার দেখা হলো। আমি বললাম : আল্লাহ্ আপনার উপর দয়া করুন, চোখের শুকরিয়া কী? তিনি বললেন : আপনি তাদের (দু’চোখ) মাধ্যমে ভালো কিছু দেখলে তা প্রকাশ করুন। আর তাদের মাধ্যমে মন্দ কিছু দেখলে তা গোপন করুন। আমি বললাম : কানের শুকরিয়া কী? তিনি বললেন : আপনি তাদের (দুই কান) মাধ্যমে ভালো কিছু শুনলে তা মনে রাখুন। আর তাদের মাধ্যমে মন্দ কিছু শুনলে তা ভুলে যান।
ইবনু রাজাব আল হানবালি (র) বলেন :
শুকরিয়া দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো ফরয (বাধ্যতামূলক)। অর্থাৎ ফরয কাজগুলো সম্পাদন করা এবং নিষিদ্ধ কাজগুলো বর্জন করা। এমনটি করা অত্যাবশ্যক এবং শুকরিয়া আদায়ের জন্য এমনটি করাই যথেষ্ট।
একারণেই একজন সালাফের মতে :
শুকরিয়া হলো পাপ কাজ ত্যাগ করা।
সালাফদের আরেকজন বলেছেন :
শুকরিয়া হলো কোনো নিয়ামত ব্যবহার করে তাঁর (আল্লাহ্র) বিরুদ্ধাচরণ না করা।
আবু হাজিম আল-যাহিদ সবধরনের শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন : এগুলোকে (শারীরিক ক্ষমতাগুলোকে) পাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এগুলোর ব্যবহার করে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য করতে কাউকে সাহায্য করা। অতঃপর তিনি বলেন : যে ব্যক্তি তার জিহ্বা দিয়ে শুকরিয়া করে কিন্তু বাকি শারীরিক ক্ষমতা দিয়ে করে না, তার অবস্থা ওই লোকের মতো, যার একটা আলখাল্লা আছে কিন্তু সে তা গায়ে না দিয়ে, হাতে ধরে নিয়ে বেড়ায়। ফলে শীতে, গরমে , তুষারে বা বৃষ্টিতে ওই আলখাল্লা তার কোনো উপকারেই আসে না।
দ্বিতীয় প্রকার শুকরিয়া হলো মুস্তাহাব। কোনো ব্যক্তি এই কাজগুলো ফরজ ইবাদত করার পর এবং নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করার পর, অতিরিক্ত বা নফল ইবাদত হিসেবে করে থাকে। শুকরিয়া আদায়ের এই স্তরটি তাদের, যারা সৎকর্মে অগ্রগামী এবং আল্লাহ্ তা‘আলা’র অধিক নৈকট্যলাভকারী। [জামি‘উল ‘উলুম ও’য়াল হুকাম (পৃষ্ঠা ২৪৫, ২৪৬)
সারকথা :
আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে চাইলে, আপনাকে অবশ্যই অন্তরে স্বীকার করতে হবে যে, সমস্ত অনুগ্রহ এবং নেয়ামতের যোগানদাতা হলেন শুধুমাত্র আল্লাহ্। এই আন্তরিক স্বীকারোক্তির ফলে আপনি আল্লাহ্কে শ্রদ্ধা এবং ভক্তির সাথে ভালবাসতে পারবেন। আপনি মুখ দিয়ে স্বীকার করবেন, তিনিই হলেন একমাত্র অনুগ্রহকারী। অতএব, ঘুম থেকে জেগে উঠেই আপনি তার প্রশংসা করবেন। কারণ তিনি আপনাকে নতুন জীবন দান করেছেন। পানাহার করার পরে তাঁর প্রশংসা করবেন। কারণ তিনি অনুগ্রহ করে আপনাকে খাইয়েছেন এবং পান করিয়েছেন। আর এভাবে প্রতিটি অনুগ্রহের জন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করবেন।
আপনি শারীরিক ক্ষমতার মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করবেন। চোখ দিয়ে মন্দ কিছু দেখবেন না। কান দিয়ে গান বাজনার মতো খারাপ কিছু শুনবেন না। পায়ে হেঁটে নিষিদ্ধ স্থানে যাবেন না। হাত দিয়ে কোনো পাপ কাজ করবেন না। যেমন : কোনো নিষিদ্ধ প্রেমপত্র বা নিষিদ্ধ চুক্তি লিখবেন না। শারীরিক ক্ষমতা দ্বারা শুকরিয়া করার মধ্যে রয়েছে কোরআন পড়া, জ্ঞান বাড়ে এমন বই পড়া , উপকারী ও প্রয়োজনীয় জিনিস শোনা । এছাড়া অন্য সকল ক্ষমতা বিভিন্ন ইবাদাত এবং আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করা উচিত।
মনে রাখবেন, আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারাটাও তাঁর পক্ষ থেকে আরেকটি নেয়ামত এবং এজন্যও শুকরিয়া আদায় করতে হবে। ফলে শোকরকারী যতই আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করে, ততই আল্লাহ্র নেয়ামত উপভোগ করে অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়।
আমরা দো‘আ করি আল্লাহ্ যেন আপনাকে আমাকে এবং সর্বোপরি সবাইকে তা-ই করার তাওফীক দান করেন যা তিনি ভালোবাসেন এবং পছন্দ করেন।
সূত্র : Islamqa
প্রশ্ন : আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে অসংখ্য নেয়ামত দিয়ে ধন্য করেছেন। আমাদের প্রতি তাঁর এই সকল নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের সর্বোত্তম উপায় কী?
প্রথমত :
ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানোর উদ্দেশ্য হলো কারও উপকার এবং সদয় আচরণের প্রতিদান স্বরূপ তার প্রশংসা করা এবং তার প্রতিও সদয় আচরণ করা। মানুষের ধন্যবাদ এবং প্রশংসা পাওয়ার সবচেয়ে যোগ্য সত্ত্বা হলেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয় তা‘আলা। কারণ জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রেই তিনি আমাদেরকে অসংখ্য অনুগ্রহের মাধ্যমে ধন্য করছেন। এইসব নেয়ামতের জন্য তিনি আমাদেরকে তার প্রশংসা করার এবং সেগুলোকে অস্বীকার না করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় করো, আমার সাথে কুফরী কোরো না।” [আল-বাকারা; ২ : ১৫২]
দ্বিতীয়ত :
যারা আল্লাহ্র এই নির্দেশের আনুগত্য করেছেন এবং তাঁর যোগ্য শোকরকারী বান্দা বলে বিবেচিত হওয়া পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা করেছেন গেছেন, তারা হলেন নবী এবং রাসূলগণ (‘আলাইহিমুস সালাম)।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“নিশ্চয়, ইবরাহীম ছিলেন (একাই) এক উম্মত (একটি জাতির জীবন্ত প্রতীক), আল্লাহ্র একান্ত অনুগত, ও একনিষ্ঠ। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার রবের নেয়ামতের শোকরকারী। তিনি তাকে বাছাই করেছেন এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছিলেন।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১২০-১২১]
“সে তাদের বংশধর, যাদেরকে আমি নূহের সাথে আরোহণ করিয়েছিলাম, নিশ্চয় তিনি ছিলেন কৃতজ্ঞ বান্দা।” [ সূরা বনী ইসরাইল; ১৭ : ৩]
তৃতীয়ত :
আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে আমাদের প্রতি তাঁর কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেসব জন্য আমাদেরকে শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, খুব অল্প কিছু মানুষই তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে থাকে।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
১। “হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযিক দিয়েছি তা থেকে আহার করো এবং আল্লাহ্র জন্য শোকর করো যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।” [সূরা বাকারা; ২ : ১৭২]
২। “আর অবশ্যই আমি তো তোমাদেরকে যমীনে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতে তোমাদের জন্য রেখেছি জীবনোপকরণ। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।” [সূরা আরাফ; ৭ : ১০]
৩। “আর তাঁর নির্দেশনসমূহের মধ্যে রয়েছে, তিনি [বৃষ্টির] সুসংবাদ বহনকারী হিসেবে বাতাস প্রেরণ করেন এবং যাতে তিনি তোমাদেরকে তাঁর রহমত আস্বাদন করাতে পারেন এবং যাতে তাঁর নির্দেশে নৌযানগুলো চলাচল করে, আর যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ থেকে কিছু সন্ধান করতে পারো। আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” [সূরা রুম; ৩০ : ৪৬]
৪। আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে যেসব আধ্যাত্মিক নেয়ামতের উল্লেখ করেছেন সেগুলো হলো (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“হে মু’মিনগণ! যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ এবং কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত করো, মাথা মাসেহ করো এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত করো)। আর যদি তোমরা অপবিত্র থাকো, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও। আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাকো অথবা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা যদি স্ত্রী সহবাস করো অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসেহ করো। আল্লাহ্ তোমাদের উপর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না। বরং তিনি তোমাদের পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের উপর তাঁর নেয়ামত পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।” [সূরা মায়েদা; ৫ : ৬]
রয়েছে আরও অনেক অফুরন্ত নেয়ামত। আমরা এখানে সেগুলো থেকে মাত্র কয়েকটা উল্লেখ করলাম। বলাই বাহুল্য যে, আল্লাহ্র সমস্ত নেয়ামতের তালিকা করা অসম্ভব। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“আর তোমরা যা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকে তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এবং যদি তোমরা আল্লাহ্র নেয়ামতের গণনা করো, তবে তার সংখ্যা নিরূপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অতিমাত্রায় যালিম, ও অকৃতজ্ঞ।” [সূরা ইবরাহীম; ১৪ : ৩৪]
আমরা আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে তিনি আমাদের ত্রুটিবিচ্যুতিকে ক্ষমা করে দেবেন এবং আমাদের প্রতি করুনা করবেন। এই মর্মে তিনি বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“আর যদি তোমরা আল্লাহ্র নেয়মত গণনা করো, তবে তার ইয়ত্তা পাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা নাহল; ১৬ : ১৮]
আল্লাহ্ না চাইলে, কেউ তাঁর প্রশংসা করতে পারে না। তাই মুসলিমরা সর্বদাই আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চেয়ে প্রার্থনা করে, যেন তিনি তাদেরকে তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া করার সামর্থ্য দান করেন। একারণেই বিশুদ্ধ হাদীসে আল্লাহ্র প্রশংসা করার জন্য তাঁর সাহায্য চেয়ে দো‘আ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মু‘আয ইবনু জাবাল (রা) বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্র রাসুল (সা) তার হাত ধরে বললেন :
“হে মু‘আয! আল্লাহ্র কসম, তোমাকে আমি ভালবাসি, আল্লাহ্র কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” তারপর তিনি বললেন, “হে মু‘আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, প্রত্যেক সালাতের শেষে তুমি বলতে ভুলে যাবে না : হে আল্লাহ্! তোমাকে উত্তমরূপে স্মরণ করার, তোমার শুকরিয়া করার এবং তোমার ইবাদত করার জন্য আমাকে সাহায্য করো।” [আবু দাউদ (১৫২২) এবং নাসা‘ঈ কর্তৃক সংকলিত; সহীহ আবি দাউদে আল-আলবানি হাদীসটি সহীহ বলে মত দিয়েছেন]
আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে, আমরা তাঁর পক্ষ থেকে আরও বেশী নেয়ামত প্রাপ্ত হবো। এই মর্মে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।’ ” [ইবরাহীম; ১৪ : ৭]
চতুর্থত :
মানুষ কীভাবে তার প্রতিপালকের দেওয়া নেয়ামতরাজির শুকরিয়া আদায় করবে? আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে সবগুলো নির্ধারিত শর্তসমূহ পূর্ণ করা অপরিহার্য। যেমন : অন্তরের শুকরিয়া, জিহ্বার শুকরিয়া এবং অন্য সকল শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া।
ইবনুল কাইয়্যিম (র) বলেন :
“অন্তরের শুকরিয়া হলো আত্মসমর্পণ এবং বিনম্রতায়; জিহ্বার শুকরিয়া হলো প্রশংসা এবং স্বীকারোক্তিতে; আর শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া হলো আনুগত্য এবং বশ্যতায়।” [মাদারিজ আল-সালিকীন (২/২৪৬)]
উল্লিখিত বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ :
১. অন্তরের শুকরিয়া : এর অর্থ হলো, আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন, অন্তর সেই অনুগ্রহসমূহকে পূর্ণ গুরুত্বের সাথে উপলব্ধি করে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে যে, কেবল আল্লাহ্ই তাকে এইসব অনুগ্রহ দান করেছেন যার কোনো শরীক বা অংশীদার নেই। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“আর তোমাদের কাছে যেসব নেয়ামত আছে তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে।” [আন-নাহল; ১৬ : ৫৩]
আমরা সমস্ত নেয়ামত যে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে পাই, তা স্বীকার করা কেবল মুস্তাহাব (উৎসাহিত) নয়; বরং তা ফরয (বাধ্যতামূলক)। এইসব নেয়ামত আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে এসেছে বলে বিশ্বাস করলে তা হবে কুফরী।
শায়েখ আব্দুর রাহ্মান আস-সা‘দি (র) বলেছেন :
“মানুষকে পরিপূর্ণভাবে স্বীকার করতে হবে যে, সমস্ত নেয়ামতরাজি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। তবেই সে পরিপূর্ণভাবে তাওহীদ-কে অর্জন করবে। যে কেউ মুখে বা অন্তরে আল্লাহ্র নেয়ামতসমূহকে অস্বীকার করবে, সে একজন কাফির এবং ইসলামের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
যে দৃঢ়ভাবে অন্তরে বিশ্বাস করে যে, সকল নেয়ামত শুধুমাত্র আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, আবার কখনও কখনও সেগুলোকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, কখনও নিজের কর্ম বা অন্যের প্রচেষ্টার ফসল মনে করে – যেমনটি অনেক মানুষের মুখে শোনা যায় – তাহলে তাকে তাওবা করতে হবে এবং সমস্ত নেয়ামতসমূহ তার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে বলে মনে করবে না এবং সে অবশ্যই নিজেকে দিয়ে তা (তাওবা) করাবে। কারণ আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে, ঈমান এবং তাওহীদ অর্জন করা যায় না।
ঈমানের মূলকথাই হলো আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করা যা তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত : বান্দার প্রতি আল্লাহ্র সমস্ত নেয়ামতকে অন্তরে স্বীকার করা এবং সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা; আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করা; এবং এই শুকরিয়াকে কাজে লাগিয়ে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত এবং আনুগত্য করা যিনি সমস্ত নেয়ামতের যোগানদাতা।” [আল-কাওল আস্-সাদীদ ফী মাকাসিদুত তাওহীদ (পৃষ্ঠা ১৪০)]
যারা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না, তারা কোন ধরণের মানুষ, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“তারা আল্লাহ্র নেয়ামত চেনে, তারপরও তা অস্বীকার করে, আর তাদের অধিকাংশই কাফির।” [সূরা নাহল; ১৬ : ৮৩]
ইবনু কাসির (র) বলেছেন : “তারা তো নিজেরাই জানে যে, একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলাই হচ্ছেন নিয়ামতরাজি দানকারী। কিন্তু এটা জানা সত্ত্বেও তারা এগুলো অস্বীকার করছে এবং তারা অন্যদের ইবাদত করছে। এমনকি তারা মনে করছে যে, সাহায্যকারী অমুক, আহার্যদাতা অমুক।” [তাফসীর ইবনু কাসির (৪/৫৯২)]
২. মুখের শুকরিয়া : এর অর্থ হলো, সমস্ত নেয়ামত রাজি শুধুমাত্র আল্লাহ্র পক্ষ থেকে – একথা অন্তরে বিশ্বাস করার পর, তা মৌখিকভাবে স্বীকার করা এবং নিজের জিহ্বাকে সর্বদায় আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র প্রশংসায় নিয়োজিত রাখা।
তাঁর বান্দা মুহাম্মাদের (সা) প্রতি তাঁর নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
“তিনি তোমাকে পেয়েছেন নিঃস্ব। অতঃপর তিনি সমৃদ্ধ করেছেন।” [সূরা আদ-দুহা; ৯৩ : ৮]
আল্লাহ্র এই নেয়ামতের জন্য রাসূলকে কী করতে হবে, তা আল্লাহ্ তা‘আলা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন :
“আর তোমার রবের অনুগ্রহ তুমি বর্ণনা করো।” [সূরা আদ-দুহা; ৯৩ : ১১]
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যা ইবনু কাসির (র) বলেছেন : “যখন আপনি নিঃস্ব এবং অভাবগ্রস্থ ছিলেন, আল্লাহ্ তখন আপনাকে সমৃদ্ধ এবং অভাবমুক্ত করেছেন করেছেন : তাই আপনার প্রতি অনুগ্রহের কথা ঘোষণা করুন।” [তাফসীর ইবনু কাসির (৮/৪২৭)]
আনাস ইবনু মালিক থেকে বর্ণিত। আল্লাহ্র রাসূল (সা) বলেছেন : “আল্লাহ্ সেই ব্যক্তির প্রতি খুশি হন, যে কোনো খাবার খাওয়ার পরে তাঁর প্রশংসা করে অথবা যে কোনো পান করার পরে তাঁর প্রশংসা করে।” [সহীহ্ মুসলিম (২৭৩৪)]
আবুল ‘আব্বাস আল-কুরতুবি (র) বলেছেন :
উল্লিখিত হাসীসে প্রশংসা বলতে শুকরিয়া আদায় করাকে বোঝানো হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, প্রশংসার মাধ্যমে শুকরিয়া হতে পারে কিন্তু শুকরিয়ার মাধ্যমে প্রশংসা নাও হতে পারে। নেয়ামত সংখ্যায় যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার জন্য শুকরিয়া আদায় করাই হলো আল্লাহ্ তা‘আলা’র সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোত্তম উপায় যা জান্নাতের অধিবাসীদের সবচেয়ে মহান বৈশিষ্ট্য। যখন জান্নাতীরা বলবে, “আপনি আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা সৃষ্টির মধ্যে অন্য কাউকে দেননি,” তখন আল্লাহ্ তাদের উদ্দেশে বলবেন : “আমি কি তোমাদেরকে তার চেয়েও অধিক উত্তম কিছু দেবো না?” তারা বলবে “সেটা কী? আপনি কি আমাদের মুখমণ্ডলগুলোকে উজ্জ্বল করেননি এবং আমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি রক্ষা করেননি? তিনি বলবেন, “তোমাদের প্রতি আমি সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম এবং এরপর আর কখনোও তোমাদের প্রতি রাগান্বিত হবো না।”
“এই বিরাট সম্মান অর্জনের উপায় হলো শুররিয়া আদায় করা। কারণ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে শুধুমাত্র আল্লাহ্কেই ওই নেয়ামতের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকার করা হয়। যিনি নেয়ামতসমূহকে সম্মান ও অনুগ্রহস্বরূপ তাঁর বান্দার নিকট পৌঁছে দেন। যে বান্দা নিঃস্ব এবং অসহায় এবং যে অনুগ্রহ ছাড়া চলতে পারে না। কাজেই শুকরিয়া আদায় করাটা আল্লাহ্র হক্ব এবং আমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি দেওয়া বান্দার অত্যাবশ্যক কর্তব্য। একারণেই আল্লাহ্ তাঁর শুকরিয়া আদায়ের পুরস্কারকে এত সম্মানজনক করেছেন।” [আল-মুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীস কিতাব মুসলিম (৭/৬০,৬১)]
এ কারনে সালাদের কেউ কেউ বলেছেন : কেউ কোনো নেয়ামতের কথা গোপন করলে সে ওই নেয়ামতকে অস্বীকার করল, আর কোনো নেয়ামতের কথা প্রকাশ করলে সে ওই ওটার জন্য শুকরিয়া আদায় করলো।
এ কথার মন্তব্যে ইবনুল কায়্যিম (র) বলেছেন :
“আল্লাহ্ যখন কোনো ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন, তিনি ওই বান্দার উপর সেই অনুগ্রহের প্রভাব দেখতে ভালোবাসেন।” [মাদারিজি আল সালেকিন (২/২৪৬)]
উমার ইবনু আব্দুল আযীয (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : (আল্লাহ্র) নেয়ামতের কথা পরস্পরকে স্মরণ করিয়ে দাও। কারণ সেগুলো আলোচনা করাও হলো শুকরিয়া আদায় করা।
৩. শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া : এর অর্থ হলো শারীরিক ক্ষমতাকে আল্লাহ্র আনুগত্যের জন্য ব্যবহার করা এবং সেগুলোকে সবধরণের পাপাচার এবং আল্লাহ্র বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যেসব কাজ আল্লাহ্ নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা) :
“হে দাউদ পরিবার, তোমরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ‘আমল করে যাও।” [সূরা সাবা; ৩৪ : ১৩]
‘আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত : “আল্লাহ্র রাসুল (সা) যখন সালাত আদায় করতেন, তিনি এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর পা দুটো ফুলে যেতো। ‘আয়েশা (রা) বললেন : হে আল্লাহ্র রাসুল! আপনি এমনটি করছেন যখন আল্লাহ্ আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? তিনি বললেন : “হে আয়েশা! আমি কি শোকর গুজারি বান্দা হবো না?” [আল-বুখারি (৪৫৫৭) এবং মুসলিম (২৮২০)]
ইবনু বাত্তল (রা) বলেছেন :
আত-তাবারি বলেছেন : এব্যাপারে বিশুদ্ধ মত হলো, শুকরিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, ওই নেয়ামত আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে নয় এবং কাজের (শুকরিয়ার) মধ্য দিয়েই তার প্রমাণ এবং যেহেতু শুকরিয়া আদায় করা হয়েছে তাই সেটা প্রমাণিত। তবে প্রমাণিত হওয়ার পর ব্যক্তির কাজকর্ম যদি ভিন্নরূপ দেখা যায়, তাহলে সে নিজেকে শোকরকারী বলার যোগ্য নয়। একে মৌখিক শুকরিয়া বলা যেতে পারে। একথা যে সত্য, তার প্রমাণ হলো আল্লাহ্ তা‘আলা’র বাণী (অর্থের ব্যাখ্যা) : “হে দাউদ পরিবার, তোমরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ‘আমল করে যাও।” [সূরা সাবা; ৩৪ : ১৩]। এটি জানা কথা যে, আল্লাহ্ যখন তাদের প্রতি তাঁর নেয়ামতের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে বলেছিলেন, তখন তিনি তাদেরকে শুধু মুখেই ওকথা স্বীকার করার জন্য আদেশ করেননি। কারণ তাদের প্রতি নেয়ামতসমূহ আল্লাহ্র দেওয়া একথা তারা অস্বীকার করেনি। বরং তিনি তাদেরকে আনুগত্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার হুকুম দিয়েছিলেন। ঠিক এ কারণেই, রাতে সালাত আদায় করার সময় যখন রাসূলের (সা) পা দুটো ফুলে যেতো, তখন তিনি বলতেন : আমি কি শোকর গুজারি বান্দা হবো না? [শাহ্র সহীহ্ আল-বুখারি (১০/১৮৩,১৮৪)]
আবু হারুন বলেন : হঠাৎ আবু হাজিমের সাথে আমার দেখা হলো। আমি বললাম : আল্লাহ্ আপনার উপর দয়া করুন, চোখের শুকরিয়া কী? তিনি বললেন : আপনি তাদের (দু’চোখ) মাধ্যমে ভালো কিছু দেখলে তা প্রকাশ করুন। আর তাদের মাধ্যমে মন্দ কিছু দেখলে তা গোপন করুন। আমি বললাম : কানের শুকরিয়া কী? তিনি বললেন : আপনি তাদের (দুই কান) মাধ্যমে ভালো কিছু শুনলে তা মনে রাখুন। আর তাদের মাধ্যমে মন্দ কিছু শুনলে তা ভুলে যান।
ইবনু রাজাব আল হানবালি (র) বলেন :
শুকরিয়া দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো ফরয (বাধ্যতামূলক)। অর্থাৎ ফরয কাজগুলো সম্পাদন করা এবং নিষিদ্ধ কাজগুলো বর্জন করা। এমনটি করা অত্যাবশ্যক এবং শুকরিয়া আদায়ের জন্য এমনটি করাই যথেষ্ট।
একারণেই একজন সালাফের মতে :
শুকরিয়া হলো পাপ কাজ ত্যাগ করা।
সালাফদের আরেকজন বলেছেন :
শুকরিয়া হলো কোনো নিয়ামত ব্যবহার করে তাঁর (আল্লাহ্র) বিরুদ্ধাচরণ না করা।
আবু হাজিম আল-যাহিদ সবধরনের শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন : এগুলোকে (শারীরিক ক্ষমতাগুলোকে) পাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এগুলোর ব্যবহার করে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য করতে কাউকে সাহায্য করা। অতঃপর তিনি বলেন : যে ব্যক্তি তার জিহ্বা দিয়ে শুকরিয়া করে কিন্তু বাকি শারীরিক ক্ষমতা দিয়ে করে না, তার অবস্থা ওই লোকের মতো, যার একটা আলখাল্লা আছে কিন্তু সে তা গায়ে না দিয়ে, হাতে ধরে নিয়ে বেড়ায়। ফলে শীতে, গরমে , তুষারে বা বৃষ্টিতে ওই আলখাল্লা তার কোনো উপকারেই আসে না।
দ্বিতীয় প্রকার শুকরিয়া হলো মুস্তাহাব। কোনো ব্যক্তি এই কাজগুলো ফরজ ইবাদত করার পর এবং নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করার পর, অতিরিক্ত বা নফল ইবাদত হিসেবে করে থাকে। শুকরিয়া আদায়ের এই স্তরটি তাদের, যারা সৎকর্মে অগ্রগামী এবং আল্লাহ্ তা‘আলা’র অধিক নৈকট্যলাভকারী। [জামি‘উল ‘উলুম ও’য়াল হুকাম (পৃষ্ঠা ২৪৫, ২৪৬)
সারকথা :
আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে চাইলে, আপনাকে অবশ্যই অন্তরে স্বীকার করতে হবে যে, সমস্ত অনুগ্রহ এবং নেয়ামতের যোগানদাতা হলেন শুধুমাত্র আল্লাহ্। এই আন্তরিক স্বীকারোক্তির ফলে আপনি আল্লাহ্কে শ্রদ্ধা এবং ভক্তির সাথে ভালবাসতে পারবেন। আপনি মুখ দিয়ে স্বীকার করবেন, তিনিই হলেন একমাত্র অনুগ্রহকারী। অতএব, ঘুম থেকে জেগে উঠেই আপনি তার প্রশংসা করবেন। কারণ তিনি আপনাকে নতুন জীবন দান করেছেন। পানাহার করার পরে তাঁর প্রশংসা করবেন। কারণ তিনি অনুগ্রহ করে আপনাকে খাইয়েছেন এবং পান করিয়েছেন। আর এভাবে প্রতিটি অনুগ্রহের জন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করবেন।
আপনি শারীরিক ক্ষমতার মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করবেন। চোখ দিয়ে মন্দ কিছু দেখবেন না। কান দিয়ে গান বাজনার মতো খারাপ কিছু শুনবেন না। পায়ে হেঁটে নিষিদ্ধ স্থানে যাবেন না। হাত দিয়ে কোনো পাপ কাজ করবেন না। যেমন : কোনো নিষিদ্ধ প্রেমপত্র বা নিষিদ্ধ চুক্তি লিখবেন না। শারীরিক ক্ষমতা দ্বারা শুকরিয়া করার মধ্যে রয়েছে কোরআন পড়া, জ্ঞান বাড়ে এমন বই পড়া , উপকারী ও প্রয়োজনীয় জিনিস শোনা । এছাড়া অন্য সকল ক্ষমতা বিভিন্ন ইবাদাত এবং আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করা উচিত।
মনে রাখবেন, আল্লাহ্র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারাটাও তাঁর পক্ষ থেকে আরেকটি নেয়ামত এবং এজন্যও শুকরিয়া আদায় করতে হবে। ফলে শোকরকারী যতই আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করে, ততই আল্লাহ্র নেয়ামত উপভোগ করে অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়।
আমরা দো‘আ করি আল্লাহ্ যেন আপনাকে আমাকে এবং সর্বোপরি সবাইকে তা-ই করার তাওফীক দান করেন যা তিনি ভালোবাসেন এবং পছন্দ করেন।
সূত্র : Islamqa
লেখক : শায়েখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ | ভাষান্তর ও সম্পাদনা : ‘আব্দ আল-আহাদ